সংবাদমাধ্যমের সৃজনশীল আন্দোলন
শরিফুল ইসলাম
২৮ মার্চ সকালে ‘সমকাল’ পত্রিকাটি হাতে নিতেই এক অনবদ্য সৃষ্টিশীলতায় চোখ আটকে যায়। সমকালের মাস্টহেড দেখে মুগ্ধ হই! কী ব্যতিক্রমী, কেমন নান্দনিক! সমকাল মাস্টহেডের চারটি বর্ণ (স ম কা ল) নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ছাপা হয়েছে। বর্ণগুলোর শূন্যস্থানে লেখা- সঠিক তথ্য জানুন।। দূরত্ব বজায় রাখুন।। ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন। করোনার ক্রান্তিকালে এমন তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাই বলে দেয়, সৃষ্টিশীল সাংবাদিতার তাৎপর্য কতখানি!
সৃজনশীলতার চর্চার মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যম যুগে যুগে যুদ্ধ, মহামারি, দুর্যোগ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এ সৃজনশীলতা কখনও প্রকাশ পেয়েছে পত্রিকার পৃষ্ঠাসজ্জার মাধ্যমে; কখনও সংবাদ, সংবাদের শিরোনাম, সম্পাদকীয় বা মাস্টহেডের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনের মাধ্যমে। উপস্থাপনায় উপমা, অলংকার ও রূপকের মাধ্যমে পত্রিকার এ পরোক্ষ সৃজনশীল আন্দোলনগুলো রূপান্তরিত হয়েছে প্রত্যক্ষ সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে।
করোনার দিনগুলোতেও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা শুধু সংবাদ পরিবেশন নয়, সৃজনশীল চর্চার মধ্য দিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করাও তার অন্যতম দায়িত্ব। সম্প্রতি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে অস্ট্রেলিয়ার সুপার মার্কেটগুলোতে টয়লেট পেপারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে গত ৫ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা ‘এন টি নিউজ’ আট পৃষ্ঠা ফাঁকা রেখে পত্রিকা প্রকাশ করে। পৃষ্ঠাগুলো সহজে কাটার জন্য ডট লাইন টেনে দেয়, যাতে পৃষ্ঠাগুলো সহজেই কেটে টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পত্রিকাটির এমন অভিনব উদ্যোগ অস্ট্রেলিয়াজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের ৬০টি সংবাদপত্র প্রথম পৃষ্ঠায় অভিন্ন প্রতিবেদন করে অভিন্ন শিরোনামে- ‘হোয়েন ইউ আর অন ইওর ঔন, উই আর দেয়ার উইথ ইউ’। প্রতিবেদনে তারা লেখে- প্রিয় পাঠক, নিরাপদে থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমাদের জানান, কীভাবে আপনাদের সেবা করে যেতে পারি। আমাদের পত্রিকা আপনার পাশে থাকবে।
শুধু সাম্প্রতিক করোনা নয়, যে কোনো দুর্যোগে সংবাদমাধ্যম তার নিজস্ব ঢং, স্বতন্ত্র গণ্ডিতে সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে সংবাদমাধ্যমগুলো এ ধারার প্রতিবাদ দেখিয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকার মাস্টহেডে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ক্রস চিহ্ন দিয়ে কেটে দেওয়া হয়; যোগ করা হয় ‘বাংলাদেশ’ শব্দ। পত্রিকাটির আট কলামজুড়ে ব্যানার লিডের শিরোনাম হয়, ‘জয় বাংলার জয়’। এদিন স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্রিকাই ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে সংবাদ ছাপায়, যে ‘জয় বাংলা’ আজ আমাদের জাতীয় স্লোগান! ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সব পত্রিকা একযোগে শিরোনাম করেছিল- ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। নব্বইয়ের আন্দোলনে সব পত্রিকা সিদ্ধান্ত নিয়ে সাত দিন পত্রিকা বন্ধ রেখেছিল।
আইয়ুব আমলেও সংবাদের শিরোনাম নিয়ে এমন একটি গল্প আছে। আইয়ুব খান তখন জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে বেসিক ডেমোক্রেট মেম্বার (বিডি মেম্বার) নামে কিছু লোক সৃষ্টি করেছিলেন। বিডি মেম্বাররা কথায় কথায় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করতেন। সে সময়কার একটি ঘটনা। এক ক্ষিপ্ত মহিষ কাকতালীয়ভাবে এক বিডি মেম্বারকে গুঁতিয়ে মেরে ফেলে। পরদিন এ ঘটনা ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় এই শিরোনামে- ‘চিনিলো কেমনে!’।
শুধু রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন নয়; সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিক নির্যাতন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হলেও সংবাদমাধ্যম তার নান্দনিক ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। গত বছর অক্টোবরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’, ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’, ‘দ্য ক্রনিকল’সহ অধিকাংশ পত্রিকা প্রথম পাতার খবরের লাইনগুলো কালো কালিতে মুছে দেয়। তার পাশে লাল কালিতে স্ট্যাম ফন্টে লিখে দেয় ‘নট ফর রিলিজ, সিক্রেট’।
পত্রিকার পাতাও কখনও কখনও হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের পোস্টার! গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল ‘আলোর পথযাত্রী’ শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি বিশেষ কাভারেজ দেয়। পৃষ্ঠাজুড়ে স্কাইভিউ শটের একটি ছবি। যে ছবিতে মোমবাতি আর মশাল হাতে হাজারো মানুষ। সেই জনসমুদ্রের মাঝখানে জাহানারা ইমামের ছবি সংবলিত একটি প্ল্যাকার্ড। দুর্দান্ত-অবিস্মরণীয় এক ছবি! ভিজ্যুয়াল প্রদর্শনী ছাড়া লিখিত বর্ণনা দিয়ে ছবিটির তাৎপর্য বোঝানো দুঃসাধ্য। সমকালের এই বিশেষ মোড়কটি সারাদেশে তখন আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত হয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের ‘তুই রাজাকার’ যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রতীকী জাতীয় স্লোগান হয়ে ওঠে, তেমনি গণমাধ্যমের এমন সৃষ্টিশীল ভাষাও হতে পারে সামাজিক আন্দোলনের ‘স্লোগান’।
শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
Source: দৈনিক সমকাল