বাংলাদেশের রেমিট্যান্স অর্থনীতি: প্রবাসী শ্রমিকরা কীভাবে দেশকে সচল রাখছেন

আপনি কি জানেন, প্রতিদিন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো অর্থ কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে? আজকের আলোচনায় আমরা জানব, কীভাবে এই রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে, কীভাবে এটি লাখো পরিবারকে জীবনের মান উন্নয়নে সহায়তা করছে, এবং ভবিষ্যতে কীভাবে এই খাত আরও শক্তিশালী হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক আয়কারী খাত। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠিয়েছেন প্রায় ২৩.৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৬৬ শতাংশ বেশি। এই প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে, ডলার সংকট মোকাবেলা করতে এবং আমদানির খরচ মেটাতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৬-৭ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ভোক্তা ব্যয়ের বৃদ্ধিতে এই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশি প্রবাসীদের প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত।
রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এই অর্থ সাধারণত পরিবারের খরচ, সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা এবং আবাসনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, কিছু প্রবাসী পরিবার ক্ষুদ্র ব্যবসা চালু করে, গরু-ছাগল পালন করে বা জমিতে বিনিয়োগ করে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখে।
সম্প্রতি মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, অনলাইন ব্যাংকিং ও এক্সচেঞ্জ হাউজের উন্নয়নের ফলে রেমিট্যান্স প্রেরণের খরচ ও সময় অনেক কমে এসেছে, যা প্রবাসীদের উৎসাহিত করছে আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহারে।
রেমিট্যান্স সরাসরি গ্রামীণ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। একসময় যেসব পরিবার কৃষি ও দিনমজুরির উপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তারা প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
গ্রামীণ এলাকায় আধুনিক ঘরবাড়ি নির্মাণ, বাচ্চাদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি, প্রাইভেট হাসপাতাল ব্যবহার, এমনকি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার—সবকিছুতেই রেমিট্যান্সের প্রভাব স্পষ্ট। অনেক সময় স্থানীয় অর্থনীতিতে এই প্রবাহ বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি করে, যা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।
যদিও রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, এখনো একটি বড় অংশের অর্থ হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে আসে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর। এতে বৈধ পথে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং সরকারের রাজস্ব আয় হ্রাস পায়।
অপরদিকে, অনেক প্রবাসী শ্রমিক দক্ষতা ছাড়াই বিদেশে যান, ফলে তারা অল্প বেতনে কষ্টকর পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এতে আয় কম হয় এবং বিদেশে তাদের মানবাধিকারও হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া, অনেকেই সামাজিক নিরাপত্তা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রবাসী আয় দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে সরকারকে কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের পেশাগত মান বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে তারা উচ্চ আয়ক্ষমতাসম্পন্ন দেশে যেতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, হুন্ডির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে বৈধ পথে অর্থ প্রেরণে উৎসাহ দেওয়া দরকার। ব্যাংক ও মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস-এর মাধ্যমে দ্রুত ও সহজ ট্রান্সফার সুবিধা তৈরি করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, জমি বরাদ্দ এবং ট্যাক্স ছাড়ের মতো সুবিধা দিতে হবে। এতে রেমিট্যান্স শুধু ভোগ খাতে সীমাবদ্ধ না থেকে উৎপাদন খাতে প্রবাহিত হবে।
প্রবাসী শ্রমিকরা শুধু তাদের পরিবার নয়, গোটা জাতির জন্য অপরিসীম অবদান রেখে চলেছেন। তাদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফসল আমাদের রেমিট্যান্স। তাই, তাদের সুরক্ষা, সম্মান ও সুযোগ নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব।