কৃষি ও কৃষকবান্ধব এক শহীদ প্রেসিডেন্ট
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে দেশের ইতিহাসে একটি নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেন তিনি। কৃষি ও কৃষকবান্ধব জিয়া সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। জিয়ার গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি কীভাবে দেশের কৃষি উন্নয়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে, তা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
জিয়াউর রহমান প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে খাল খনন কর্মসূচি শুরু করেন। সমাজকে সংগঠিত করার এক অনন্য নজির হচ্ছে খাল খনন কর্মসূচি। আপাতদৃষ্টে এ কর্মসূচিকে শুধুই খাল খনন মনে করা হলেও এই কর্মসূচির বহুমুখী উদ্দেশ্য ছিল—কৃষিতে সেচ নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সারা দেশে খাল খনন করে প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে উপরিভাগের পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া খালগুলোতে মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি খাল খনন করা হয়। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খনন ও পুনঃখনন করা হয়। আর এ খাল খননের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল কৃষিতে। এটা অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের সেচসুবিধা ছিল কৃষকদের জন্য। ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় বহন করতে হয়নি কৃষকদের। শুধু সেচের আওতায় বৃদ্ধি নয়, গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য সহায়তারও পথ খুলে দিয়েছিল খাল খনন কর্মসূচি। কার্যত খাল খনন কর্মসূচি একসঙ্গে অনেক সাফল্য অর্জনের একটি পরিকল্পিত কর্মসূচি ছিল। এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার বিভিন্ন পরিকল্পনার মধ্যে এক ধরনের গণভিত্তিক কর্মসূচি লক্ষ করা যায়। তাই কৃষিজমির আল বা বিভাজনও তুলে দেওয়ার কথা জিয়া বলেন। অনেকেই মনে করেন, দেশে কৃষি খাতে যৌথ খামার পদ্ধতি শুরু করার পরিকল্পনা ছিল জিয়ার। জিয়াই সরাসরি কৃষি সমবায়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে উদার অর্থনীতির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার সমন্বয়ের চিন্তাও হয়তো তার ছিল। তিনি আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো এ কাজ অসম্পূর্ণ থাকত না। আর এসবের পাশাপাশি তিনি নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেছেন। যেমন আগে সেচ ও কৃষি যন্ত্রের খাত পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু জিয়ার আমলে কৃষি খাতে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। সেচের জন্য গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গড়ে ওঠে। একজন সেচযন্ত্র কিনে অন্যদের চাষের জমিতে পানি সরবরাহ করত। এ ধরনের গণভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়।
সব ফসলের মূল ও প্রধান উপকরণ হলো বীজ। ভালো বীজ মানে ভালো ফসল-রাষ্ট্রপতি জিয়া একজন বিজ্ঞানীর মতোই এ কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে বীজ অধ্যাদেশ প্রণয়নের মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী কর্মসূচি হাতে নেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া কৃষির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য কৃষকের হাতে উন্নতি প্রযুক্তি দ্রুত পৌঁছানো এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃষিতে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি কৃষি উপকরণ বিতরণ ব্যবস্থা সংস্কার, কৃষি উপকরণ ব্যবসা উদারীকরণ নীতি প্রণয়ন করেন। বীজের পর ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হলো রাসায়নিক সার, সেচ ও সেচ যন্ত্র (শ্যালো টিউবওয়েল, ডিপ টিউবওয়েল), আধুনিক চাষ যন্ত্র (পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, রিপার, হার্ভেস্টার) ইত্যাদি। কৃষক যেন শস্য সংগ্রহের সময় তার ফসল বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যের আপদকালীন মজুত গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। কৃষকদের শস্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে তিনি ভালো দামে তাদের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জিয়ার শাসনামলে ১৯৮০-১৯৮১ অর্থবছরে ধান/চাল সংগ্রহ অভিযানে রেকর্ড পরিমাণ (১.০৩ মিলিয়ন টন) চাল সংগ্রহ করা হয় (শাহাব উদ্দিন ও ইসলাম, ১৯৯১)। তার শাসনামলেই ধানের বাম্পার ফলনের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রথম চাল রপ্তানি করা হয়। দেশের মানুষ তথা দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে জিয়া বিশেষ কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। শস্য সংগ্রহের সময় শস্যের দাম সাধারণত কম থাকে আবার একই শস্য কিছুদিন পর বেশি দামে কৃষককে কিনে খেতে হয়। কৃষক যেন শস্য সংগ্রহের সময় তার ফসল বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য তিনি ১৯৭৮ সালে শস্য গুদাম ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর এতে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হন।
কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যেন সহজেই কৃষিকাজের জন্য ঋণ সুবিধা পান, সেজন্য তিনি ১৯৭৭ সালে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ কৃষি ঋণ কর্মসূচি প্রণয়ন করেন, যা বাংলাদেশের কৃষি ঋণ প্রবাহে নতুনমাত্রা যোগ করে এবং দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ ছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামোকে উন্নত করার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যার দায়িত্ব ছিল গ্রাম অঞ্চলকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা। আর এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেচ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি করা, যেন পল্লি এলাকার জনগণের জীবনমানের উন্নতি হয়। দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবসমাজ যেন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়, সেজন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যুব মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও ১৯৮১ সালে যুব উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। যার মাধ্যমে দেশে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা তৈরি ও বেকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এ ছাড়া ১৯৮১ সালে তিনি আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, যার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। আরও কয়েকটি সার কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা তিনি দেখে যেতে পারেননি। এ ছাড়া চিনি শিল্পের উন্নয়নে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশে চিনি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেজন্য তিনি ১ জুলাই ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন একীভূত করে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন গঠন করেন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান গমের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই গমের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গম গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেন। জিয়ার শাসনামলে ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে নশিপুর, দিনাজপুরে গম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে বহু ফসল নিয়ে গবেষণা করে এ রকম একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট যেটি গাজীপুরে অবস্থিত, যা জিয়াউর রহমানের সময়ে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন। সার্বিকভাবে কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ, স্বতন্ত্র গবেষণা, বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, দেশের বিভিন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশ অঞ্চলে খাপ খাওয়ানো উপযোগী জাত ও ও উন্নয়ন, কৃষক প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য ম্যানডেট নিয়ে এ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে, যা কৃষির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমের নানান অন্তর্ভুক্তি ছিল একটি সময়োচিত দৃঢ় পদক্ষেপ। তার গৃহীত কর্মসূচি ও নীতিমালার সুফল মাত্র দুই বছরের মধ্যেই দেশের মানুষ পেতে শুরু করেছিল; যা দেশের সবুজ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও রাজনীতিকদের মধ্যে তিনিই অগ্রদূত যিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, মাঠেঘাটে, হেঁটে ছুটে বেড়িয়েছেন—কখনো লাঙল হাতে, কখনো কাস্তে হাতে; আবার কখনো কোদাল হাতে। জিয়া কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছেন, সমস্যা জেনেছেন, কৃষকের সঙ্গে কাজে অংশ নিয়েছেন, কৃষকদের অনুপ্রাণিত ও জাগ্রত করেছেন। অত্যন্ত সৎ, নির্লোভ ও দূরদর্শী এ রাষ্ট্রনায়কের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছিল ব্যাপকভাবে। তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ পরিণত হয়েছিল খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ হিসেবে। আর এভাবেই জিয়া একজন জনবান্ধব রাজনৈতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
লেখক: কৃষিবিদ, কৃষি গবেষক ও বিশ্লেষক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সোর্স: কালবেলা