এই সময়ের প্রযুক্তিগত দক্ষতা তরুণদের অর্জন করতেই হবে

বর্তমান যুগে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, বিশেষ করে আইসিটি বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে প্রযুক্তি-জ্ঞান এবং দক্ষতার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে দেখিয়েছে, কীভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে একদিকে ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায় এবং অন্যদিকে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। 

২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান সময়ে আইসিটি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থানের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাকিঞ্জে অ্যান্ড কোম্পানির গবেষণায়ও উল্লেখ করা হয়, কেবল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ কর্মীর অভাবের জন্য বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে। 

এই ঘাটতি মূলত ডেটা অ্যানালিটিক্স, সাইবার সিকিউরিটি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ক্লাউড কম্পিউটিং, এবং নেটওয়ার্কিংয়ের মতো প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রগুলোতে আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের ডেটা সুরক্ষার জন্য দক্ষ সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞের সন্ধান করে, অথচ সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞের অভাবে অনেক কোম্পানি তাদের ডেটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। 

বাংলাদেশেও প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি ক্রমশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০% কাজ আগামী দশকের মধ্যে প্রযুক্তি-নির্ভর হয়ে উঠবে, যা নতুন ধরনের আইসিটি এবং ডিজিটাল দক্ষতার প্রয়োজন সৃষ্টি করছে। দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, দক্ষ জনবল না থাকায় সেই চাহিদা পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

আইওটি এবং স্মার্ট টেকনোলজি এখন নতুন বাস্তবতা। বাংলাদেশের কৃষিখাতে আইওটি (ইন্টারনেট অফ থিংস) ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে। স্মার্ট সেন্সরের মাধ্যমে মাটি ও ফসলের তথ্য সংগ্রহ করে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণে দক্ষ আইসিটি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন রয়েছে, যাদের দক্ষতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা কমে যায়।

ই-গভর্ন্যান্স সাম্প্রতিক বিশ্বের আলোচিত এক বিষয়।  বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ই-গভর্ন্যান্স বা ইলেকট্রনিক গভর্ন্যান্স চালু করেছে, যার মাধ্যমে সরকারি সেবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ই-ট্রেড লাইসেন্স, অনলাইন ভোটার নিবন্ধন, এবং ই-ট্যাক্স প্রদান ব্যবস্থা। এসব সেবা কার্যকর ভাবে পরিচালনা করতে দক্ষ আইসিটি কর্মীর প্রয়োজন রয়েছে, যারা সরকারি ডেটা সিস্টেমকে সুরক্ষিত এবং নির্ভুলভাবে পরিচালনা করতে পারে।

ডিজিটাল মার্কেটিং এবং ই-কমার্স বদলে দিচ্ছে বৈশ্বিক বাণিজ্য। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। শপিফাই, দারাজ ও বিক্রয় ডট কমের মতো ই-কমার্স সাইটগুলোতে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সঠিক ডিজিটাল মার্কেটিং দক্ষতার প্রয়োজন। ফলে, এসইও, এসইম এবং কন্টেন্ট মার্কেটিংয়ের মতো দক্ষতাগুলো এখন স্থানীয় এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করার জন্য তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক আইসিটি প্রশিক্ষণে উদ্বুদ্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশে তরুণদের প্রযুক্তি শিক্ষায় উন্নীত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালা, অনলাইন কোর্স এবং আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমাদের তরুণদের জন্য একটি উন্নত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। 

আমি নিজেও এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিভিন্ন উদ্যোগে কাজ করেছি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তি খাতে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে আইসিটি কোর্স এবং কর্মশালার মাধ্যমে তরুণদের প্রযুক্তি খাতের প্রস্তুতির জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। এগুলোতে অংশগ্রহণ তরুণদের কর্মজীবনে  আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে। আমাদের ছেলে মেয়েরা যদি তাদের এই দক্ষতার দিক দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে তবে দেশেই না, বিদেশের মাটিতেও ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারবে। 

লেখক: খান ফারহানা, আইসিটি বিশেষজ্ঞ

সোর্স: ভোরের কাগজ

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.