চামড়া খাতে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন

বাংলাদেশ দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। কোভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এবং সামগ্রিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখনো সন্তোষজনক বলা যেতে পারে। গত এপ্রিলে বাংলাদেশের উন্নয়নবিষয়ক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.২ শতাংশ হতে পারে বলে জানিয়েছে। যদিও সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে দেশটির রপ্তানি খাত, যা প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। যেখানে আমাদের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে ২০২২-২৩ অর্থবছরে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার খাতের সম্মিলিত অবদান হচ্ছে ৮৪.৫৮ শতাংশ।

রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল থাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রপ্তানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বহিরাগত অভিঘাত ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব। আর এ রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম চামড়া শিল্প। চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিল্পটি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এখন দেশের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি খাত।

বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের বিশাল সম্ভাবনার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামালের সহজলভ্যতা। আমাদের দেশে সারা বছরই গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু জবাই হয়। তাছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় পবিত্র ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল ইত্যাদি পশু কুরবানি হয়। বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ আসে এ কুরবানির পশু থেকে। ফলে বাংলাদেশে চামড়ার পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ রয়েছে। এসব চামড়াই আমাদের দেশে এ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যা চামড়া শিল্পের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করে। বাংলাদেশি পশুর চামড়ার মান অন্যান্য দেশের থেকে উন্নত হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের যথেষ্ট সুনাম এবং চাহিদা আছে। বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, রয়েছে সরকারি সমর্থন। চামড়া শিল্পের উন্নয়নের জন্য গবেষণা, প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, পরিবেশ রক্ষা, অধিকতর পরিচ্ছন্ন উৎপাদন এবং অবকাঠামোবিষয়ক প্রকল্প গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে ‘চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা-২০১৯’ গ্রহণ করে।

এটা সত্যি যে, চামড়া শিল্পের অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে; কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে তা এখনো সেভাবে পুরোপুরি বিকশিত হতে পারেনি। চামড়া শিল্প খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপ্লায়েন্সের অভাব দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা। এদেশে দুই দশকেও এ শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি)-এর সনদ পওয়া যায়নি এখনো। ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা আমদানিকারকদের কাছে সরাসরি চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না। ফলে এ খাতে রপ্তানিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়াও চামড়া শিল্পের বিকাশের অন্যতম বাধা। কুরবানির সময় চামড়া বিক্রি হয় নামমাত্র মূল্যে। এছাড়া চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা এবং ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অতীতে চামড়া নদীতে ফেলে বা মাটিতে পুড়িয়ে ফেলার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে; যা চামড়া শিল্পের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। বর্তমানে সরকার কুরবানি পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করলেও কাঁচা চামড়া বিক্রেতারা তা ন্যায্য মনে করছেন না। দেশে কাঁচা চামড়ার ন্যায্যমূল্য না থাকায় বাড়তি লাভের আশায় প্রতিবছর কিছু চোরাকারবারি চামড়া পাচার করছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। কমপ্লায়েন্সের দুরবস্থা, কাঁচামাল ক্রয়সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও সিইটিপির অপর্যাপ্ত সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বাজারে ফ্যাশন ও বিপণন ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার ঘাটতি, ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগের ঘাটতি, সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর সীমিত সক্ষমতা, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের অভাবসহ বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এ চামড়া শিল্পে।

বাংলাদেশ যদি এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়, তবে আগামী বছরগুলোয় এ চামড়া শিল্পের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং নতুন রপ্তানি খাতের বিকাশ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। ব্যবসা এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার মাধ্যমে মানসম্পন্ন প্রক্রিয়াজাত চামড়া উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ, বিভিন্ন ধরনের সহায়ক পরিষেবা প্রদান এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে চামড়া শিল্পকে একটি সম্ভাব্য নির্ভরযোগ্য রপ্তানিমুখী ও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসাবে গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয়।

সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সোর্স: যুগান্তর

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.