পিকাসো তার মা-বাবার ডিএনএ থেকে জন্ম নিলেও গোটা বিশ্ব সম্পর্কে শেখার ঘটনা আসলে তার নিজস্ব সৃজনশীলতার ফলাফল। এজন্য আপনি তো তার মা বাবা’কে কৃতিত্ব দেবেন না।

প্রযুক্তি ডেস্ক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বিভিন্ন পেইন্টিং, ছবি এমনকি ভাস্কর্য তৈরিতেও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা গেছে, যেখানে কিছু কিছু শৈল্পিক কাজ বিক্রি হচ্ছে হাজার হাজার ডলারে। এতে করে শিল্পের জন্য নতুন সংজ্ঞা তৈরি করার প্রশ্নটিও উঠছে।

আই-ডা’র মতো রোবট বা বিভিন্ন এআই অ্যালগরিদম কি মানব সৃজনশীলতা ও শিল্পের সমাপ্তি? না এগুলো আমাদের সৃজনশীল সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দেবে? সেটাই এই সময়ের বড় জিজ্ঞাসা।

প্রবাহমান শিল্প

বিংশ শতকের শুরুতে, ফরাসি ভাস্কর্য শিল্পী মার্সেল দুশম্প প্রস্তাব করেছিলেন, তার তৈরি সিরামিকের কমোডকেও শিল্পকর্ম হিসাবে বিবেচনা করা উচিৎ। এমনকি সে সময়ে নিউ ইয়র্কের এক প্রদর্শনীতেও ওই ভাস্কর্য জমা দিয়ে গোটা শিল্প জগতের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

তার যুক্তি ছিল, শিল্পীর বাছাই করা যে কোনো কিছুকেই শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ গভীর বিপ্লবী ধারণা আগের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যেখানে শিল্পকে স্রেফ সুন্দর, প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ ও আবেগ জাগানিয়া বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

একইভাবে এই যুগে এসে এআইয়ের বানানো শৈল্পিক কাজ শিল্পের প্রচলিত রীতিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি লন্ডনের দার্শনিক অ্যালিস হেলিওয়েলের যুক্তি, আমরা যদি দুশম্পের কমোডের ভাস্কর্যকে যুক্তিসঙ্গত ও বৈচিত্র্যময় একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে থাকি, তবে জেনারেটিভ এআই অ্যালগরিদম থেকে তৈরি শিল্প নাকচ হচ্ছে কেন? কারণ উভয় ঘটনা নিজ নিজ সময়ে বিতর্কিত ও এগুলোতে বিভিন্ন এমন বস্তু ব্যবহার হয়েছে, যেগুলো শিল্পীর ‘নিজ হাতে তৈরি’ নয়।

“ঐতিহাসিকভাবেই, শিল্পের সংজ্ঞা নিয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণায় পরিবর্তন এসেছে,” বলছেন হেলিওয়েল।

“একটা কমোড যদি শিল্প হয়, তাহলে জেনারেটিভ অ্যালগরিদম থেকে তৈরি শিল্প নিয়ে এত আপত্তি কেন?”

ইতিহাসে যতগুলো শিল্প আন্দোলন হয়েছে, এদের সবগুলোতেই তৎকালীন যুগের সাংস্কৃতিক মনোভাব, সামাজিক ব্যস্ততা এবং উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা গেছে। এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, টার্নারের তৈরি করা কারখানা শ্রমিকদের পেইন্টিং বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র বিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে ঝোঁক থাকার বিষয়টি।

এআই প্রযুক্তিও ভিন্ন কিছু না, যাকে আই-ডা’র মতো হিউম্যানয়েড শিল্পীর অস্তিত্ব থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে আখ্যা দিয়েছেন আই-ডার দুই নির্মাতা, গ্যালারিস্ট এইডান মেলার ও গবেষক লুসি সিল।

এ নারী রোবটটি সমসাময়িক সমাজের ভীতি বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ, যেখানে মানুষের চাকরি কেড়ে নেওয়ার মতো এআই অ্যালগরিদমের উত্থান ও রোবটের আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে।

শিল্পী কে?

ডাল-ই ও মিডজার্নি’র মতো অসংখ্য টেক্সট-টু-ইমেজ জেনারেটরের বিশ্বাসযোগ্য ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ তৈরির ও বিভিন্ন লোভনীয় শিল্প প্রতিযোগিতা জেতার সক্ষমতা আছে। অন্যদিকে আই-ডা’র শৈল্পিক প্রক্রিয়াটি কেবল প্রশিক্ষণ পাওয়া ডেটার ওপর নির্ভর করে না।

এ ছাড়া, নিজের চোখে থাকা ক্যামেরাও ব্যবহার করে থাকে রোবটটি, যার ফলে তার অ্যালগরিদমে অভিনব ছবি উঠে আসে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি। ফলে, এটি বিভিন্ন এমন নতুন ও বিশেষ শিল্প তৈরি করতে পারে, যেগুলো মানুষের তৈরি করা ডেটাসেট থেকে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এ প্রক্রিয়া থেকে নিজের পোর্ট্রেইটও তৈরি করেছে রোবটটি।

“তবে, এর মেধাসত্ত্ব কার? রোবটের নিজের? বা এটা কি কম্পোজিশন তৈরির কৃতিত্ব পেতে পারে? অথবা এটি যাদের কাজের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষিত বা এর অ্যালগরিদমের নির্মাতা এমনকি যারা এর কোড লেখার কাজ করেছিলেন তাদের?” প্রতিবেদনে বলেছে বিবিসি।

এমন সৃজনশীলতা নিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ সাসেক্স-এর কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের গবেষক মাগ্রেট বোডেন। আইডিয়া তৈরির এ সক্ষমতাকে নতুন, মূল্যবান ও রোমাঞ্চকর কিছু হিসেবে দেখেন তিনি।

রোবটটির নির্মাতাদের যুক্তি, তার এ সংজ্ঞা ব্যবহার করেই আই-ডা’র মতো মেশিনগুলোকে সৃজনশীল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে অ্যালগরিদম বা রোবট যাই হোক না কেন, খোদ রোবটকে মানুষের মতো সৃজনশীল সত্ত্বা বা ‘শিল্পী’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। আর এক্ষেত্রেই কাজের মালিকানার বিষয়টি উঠে আসে।

এদিকে, কাজের মেধাস্বত্ব ও ডেটা মালিকানা নিয়ে ওঠা বিভিন্ন প্রশ্নও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করে।

সম্প্রতি লন্ডনের সার্পেনটাইন গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন জার্মানির হলি হার্নডন ও যুক্তরাজ্যের ম্যাট ড্রাইহার্স্ট, যেখানে তারা এআই যুগে ডেটা অপব্যবহার ও মেধাসত্ত্বের মতো বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে চেয়েছেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিবিসি।

এই জুটি ‘স্পনিং এআই’ নামের একটি টুলও বানিয়েছে, যার লক্ষ্য মানব শিল্পীদের ক্ষমতায়ন ও তাদের কাজ নকলের ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি ঠেকানো। এমনকি তাদের কাজ এরইমধ্যে এআই কোথাও ব্যবহার করেছে কি না, তা খুঁজে বের করতে পারে টুলটি।

অনেক শিল্পীর জন্য উদ্বেগের বিষয় হল, তাদের কাজ চুরি করে কোনো এআই অ্যালগরিদম প্রশিক্ষিত হচ্ছে কি না।

এদিকে আবার শিল্পীদের একটি অংশের কাছে এআই বিবেচিত হচ্ছে সৃজনশীলতা দেখানোর নতুন মাধ্যম হিসেবে। এর মধ্যে কয়েকজন শিল্পী যেমন সাউগুয়েন চাং নিজেদের কাজে এমন বিশেষ অ্যালগিরদমের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যা তাদের সৃজনশীলতার পরিসীমাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, জেনারেটিভ এআই অ্যালগরিদম প্রশিক্ষণে যে মেশিন লার্নিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়, তা হয়ত নিজেই এক ধরনের সৃজনশীল প্রক্রিয়া।

“উদাহরণ হিসেবে, এরইমধ্যে থাকা বিভিন্ন শিল্পকর্ম বা ডেটায় কোড বসালে এআই প্রযুক্তি আরও শেখার, রূপান্তরিত হওয়ার ও বিবর্তনের সুযোগ পায়,” বলছেন ব্রিটিশ গণিতবিদ মার্কাস পিটার ফ্রান্সিস দু সাউতয়।

“এর মানে এ প্রক্রিয়ার শেষে তৈরি হওয়া কোড মানুষের লেখা আসল কোডের চেয়ে একদম আলাদা অর্থাৎ ওই কোড থেকে এমন কিছু তৈরি করার সম্ভাবনা থাকে, যাকে মানুষের শুরু করা প্রক্রিয়ার চেয়ে বরং খোদ কোডের সৃজনশীলতা বলাই বেশি সমীচীন।”

“এটা অনেকটা এমন যে, পিকাসো তার মা-বাবার ডিএনএ থেকে জন্ম নিলেও গোটা বিশ্ব সম্পর্কে শেখার ঘটনা আসলে তার নিজস্ব সৃজনশীলতার ফলাফল। এজন্য আপনি নিশ্চিতভাবেই তার মা বাবা’কে কৃতিত্ব দেবেন না, যদিও সবকিছু শুরু হয়েছে ডিএনএ বা কোড থেকেই।”

শিল্প কি শুধুই মানুষের?

বিভিন্ন সত্যিকারের শৈল্পিক মেশিন মানুষের দীর্ঘদিনের প্রচলিত এক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, তা হল, শিল্প কেবল মানুষের বিশেষ প্রতিভা, যেখানে অন্যরা এর নান্দনিকতার প্রশংসা করবে ও এতে নির্মাতার আবেগ ফুটে উঠবে। এটি এমন এক ভিজুয়াল মাধ্যম, যা শিল্পীর আকাঙ্ক্ষা, ভীতি, হতাশা ও শ্রদ্ধা এমনকি তার শিল্প তৈরির ব্যবহারিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক কারণ ফুটিয়ে তোলে।

“সৃজনশীলতা কখনও শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে না, এর শিল্পী মানুষ, রোবট বা অ্যালগরিদম, যেটাই হোক না কেন।”

তথ্যসূত্রঃbdnews24.com

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.