আলপিন থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক পণ্য সবই হচ্ছে প্রকৌশল শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। আর এই শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। এসব উদ্যোক্তা এখন স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। তৈরি করছেন অত্যাধুনিক সব যন্ত্র। আর এর সঙ্গে যন্ত্রপাতি। এই যন্ত্রপাতি দেশের বাইরে রফতানি হচ্ছে। কী পরিমাণ রফতানি হচ্ছে তার সঠিক হিসাব না পাওয়া গেলেও, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতকোটি ডলার তো হবেই। 

এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তৈরি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আগে যে পরিমাণ বিদেশে রফতানি হয় তা এখন অনেকটা কমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। কেন কমে গেল, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মূলত নীতিগত সহায়তা, ডলার সংকট ও দক্ষ জনবলের অভাবে এই অবস্থা হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে কাঁচা মালামাল আমদানি অনেক ক্ষেত্রে কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে রফতানি খাতে। 

জানা গেছে, হালকা প্রকৌশল শিল্পের বৈশ্বিক বাজার এখন প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজারের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছে। এই খাতকে ঘিরে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। 

এর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে হালকা প্রকৌশল পণ্যকে বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেই এই পণ্যের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এরপরও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে হালকা প্রকৌশল শিল্পে ছিল নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আর আগামীতে যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তা হলে চলতি অর্থবছরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। 

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয় হয়েছে ১২ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৩ কোটি ডলার। বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় এসেছে ৫৮ কোটি ডলার। অথচ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কম আয় হয়েছে। 

কেন আয় কমল? এই প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, মূলত করোনা ও বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যে ডলার সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমদানি ব্যাহত হয়েছে। আর আমদানি ব্যাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে রফতানি কমেছে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবদুর রাজ্জাক জানান, দেশের শিল্প-কারখানার জন্য ১ হাজার ২০ কোটি ডলারের মোল্ড আমদানি করা হয়। যার পুরোটাই দেশে তৈরি করা সম্ভব। আর এই শিল্পের জন্য যে কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও করের চাপ রয়েছে তা দ্রুত কমানো প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, কাঁচামাল আমদানিতে অনেক শুল্ক। অথচ সম্পূর্ণ তৈরি  পণ্য আমদানিতে শুল্ক কম। এই ধরনের বৈষম্য থেকে সরে আসতে হবে। শুধু কর অবকাশ নয়, এই খাতের জন্য যা বেশি প্রয়োজন তা হলো নীতিগত সহায়তা। ধোলাইখাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই জায়গাটা নতুন করে উন্নয়ন করতে হবে। এখানকার তৈরি পণ্য দিয়ে বিশ্বে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। তিনি এই ধোলাইখালকে পুতুলের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এদের এখন ভালো কাপড়-চোপড় পরিয়ে বিয়ে দিতে হবে। গ্লোবাল মার্কেটের জন্য ধোলাইখাল এখন আর উপযুক্ত নয়। আর এখানকার তৈরি পণ্য দিয়ে রফতানি বেশি আশা করাও ঠিক নয়। 

তিনি বলেন, এই হালকা শিল্প নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। যে নীতিমালার ভিত্তিতে এই হালকা শিল্প এগিয়ে যাবে। এই শিল্পের জন্য ইতিমধ্যে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, রফতানি বাড়াতে হলে একটি নির্দিষ্ট শিল্পপার্ক প্রয়োজন। এই পার্ক নির্মাণের কাজ অনেক দিন ধরে চলছে। এই পার্ক দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। বর্তমান হালকা প্রকৌশল পণ্য রফতানিতে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে এলসি ছাড়া নগদে রফতানিমূল্য পরিশোধ করা হলে ওই সহায়তা নিতে পারছে না উদ্যোক্তারা। 

এদিকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, রফতানি পণ্য হিসেবে বাইসাইকেল অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে পণ্যটি এখন রফতানি হচ্ছে বিদেশে। এ ছাড়াও লৌহজাত ঢালাই, ইলেকট্রনিক পণ্য, প্রকৌশল যন্ত্রসহ আরও পণ্য বিদেশে যাচ্ছে। 

জানা গেছে, বর্তমানে পাঁচটি জেলায় হালকা প্রকৌশল শিল্পপার্ক হচ্ছে। এসব শিল্পপার্ক যত দ্রুত নির্মাণ সম্পন্ন হবে ততই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। কোনো কোনো উদ্যোক্তা মনে করেন, এই খাতের জন্য ১০ বছর মেয়াদে সুদবিহীন ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। ঋণ দিলে এই খাতের অনেক পরিবর্তন আসবে। দেশ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি উপকৃত হবে শিল্প উদ্যোক্তারা।

উৎসঃসময়ের আলো ।

Leave comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *.